কাগজের বিবর্তন

প্রাচীন মিশরে এক ধরণের নলখাগড়া জাতীয় জলজ উদ্ভিদ (Cyperus Papyrus) থেকে তৈরি এক ধরনের কাগজ তৈরি করা হতো। ছবি: সংগৃহীত

কাগজের ইংরেজী প্রতি শব্দ পেপার। প্যাপিরাস থেকে পেপার শব্দটি এসেছে। বর্তমান সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ শিল্প পণ্যের একটি কাগজ। বই, ম্যাগাজিন, সংবাদপত্র, ইত্যাদি ছাপার অপরিহার্য এই উপাদানটি শিল্প ও সভ্যতার বাহন রূপে টিকে আছে বহু বছর ধরে। বর্তমানে উপাদান ও প্রস্তুত প্রণালীর উপর কাগজের মান নির্ভর করে।  কাগজ তৈরির উপাদান মূলত সেলুলাসযুক্ত আঁশ। প্রতিটি গাছের কোষ প্রাচীরে এই রাসায়নিক উপাদানটি বিদ্যমান। পানির সাথে মিশিয়ে এই আঁশ মসৃণ জালির উপর দিয়ে প্রবাহিত করলে আঁশগুলো পরস্পর যুক্ত হয়ে কাগজে রূপ নেয়। শুকানোর পর কাগজের রাসায়নিক উপাদানগুলো দৃঢ়ভাবে পরস্পর যুক্ত হয়। বিভিন্ন উৎস থেকে কাগজ তৈরির কাঁচামাল সংগ্রহ করা হয়। এসবের মধ্যে রয়েছে বাঁশ, কাঠ, তুলা, আখের ছোবরা, শন, ধান ও গমের বিচালী ইত্যাদি।  

আদি রূপ থেকে বর্তমানের কাগজের আবির্ভাব সল্প সময়ে হয়নি, রয়েছে বহু বছরের এক চমকপ্রদ ইতিহাস। বর্তমান কাগজের আদিরূপ হিসেবে বলতে পারি প্যাপিরাস (Papyrus) কে। প্রাচীন মিশরে এক ধরণের নলখাগড়া জাতীয় জলজ উদ্ভিদ (Cyperus Papyrus) থেকে তৈরি এক ধরনের কাগজ তৈরি করা হতো। এই উদ্ভিদকে লম্বালম্বিভাবে খুব পাতলা ফালি বানিয়ে পাশাপাশি পেতে রাখা হতো। এর উপর আরেক পাতলা ফালি আড়াআড়িভাবে বিছিয়ে রোদে শুকাতে দেওয়া হতো। রোদের তাপে ফালি থেকে নির্গত হওয়া রস দুই স্তরকে একত্রে জুড়ে দিতো। এভাবে তৈরি হতো লেখার উপযোগী একধরনের অমসৃণ লালচে চাদর বা তুলট কাগজ। একেই বলা হতো প্যাপিরাস। খাগড়ার তৈরি কলম দিয়ে এই কাগজে লেখা হতো। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৬৫০ এর দিকে আহমেস (অযসবং) নামে একজন লিপিকার গণিতের একটি পুরনো পাণ্ডুলিপির অনুলিপি প্যাপিরাস কাগজে পুস্তিকাকারে প্রকাশ করেন। আহমেসের নামানুসারেই এ পুস্তিকাকে আহমেস’স প্যাপিরাস (Ahmes Papyrus) বলা হয়ে থাকে। 

বর্তমানে আমরা যে ধরণের কাগজের সাথে পরিচিত তার আবিস্কার কিন্তু চিনে। ১০৫ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট হোতাই-এর রাজ কর্মচারী সাইলুন প্রথম এই ধরণের কাগজ তৈরি করেন। প্রথমদিকে তুঁতগাছের ভেতর থেকে আঁশ সংগ্রহ তৈরি করা হতো  এধরণের কাগজ। পরে চিনারা আরো বহুবিধ উপকরণ থেকে কাগজ তৈরির প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেন। তারা পুরানো মাছ ধরার জাল থেকেও কাগজের মন্ড তৈরি করে। চিনাদের কাছ থেকে কাগজ তৈরির শিল্প সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। মধ্য এশিয়া জয়ের পর মুসলিম বণিকেরা (চীনদের কাছ থেকে) কাগজ শিল্প বিভিন্ন জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করে। ৭৯৫ খ্রীষ্টাব্দে বাগদাদে প্রথম কাগজ শিল্প স্থাপিত হওয়ার ফলে মুসলমানদের শিল্পের অকল্পনীয় উন্নতি ঘটে। আরবদের উত্তর আফ্রিকা অভিযান ও খৃষ্টানদের ক্রুসেডের মধ্যদিয়ে আফ্রিকা ও ইউরোপে কাগজ প্রস্তুত প্রণালী রফতানি হয়ে ১৬৯০ সালে ফিলাডেলফিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কাগজকলটি স্থাপিত হয়। ১৭৯৮ সালে নিকোলাসলুইস রর্বাট নামে এক ফরাসী দীর্ঘ রোল-এর আকারে কাগজ তৈরির যন্ত্র আবিস্কার করেন। তার আগ অব্দি সময় পর্যন্ত কাগজ তৈরি হতো আলাদা আলাদা শীটে। এই যন্ত্রটির নামকরণ করা হয় ফোরড্রাইনার মেশিন।  ১৮৪০ সালে জার্মানীতে কাগজের মন্ড তৈরির ব্যাপক ব্যবহৃত স্টোন গ্রাউন্ড পদ্ধতি আবিস্কৃত হয় যার ফলে রাতারাতি পরিবর্তন আসে এই শিল্পে। 

১৮৫৪ সালে ইংল্যান্ডে রাসায়নিক পদ্ধতিতে মন্ড তৈরির প্রক্রিয়া আবিস্কৃত হয়। ১৮৫০ এর দশকে র্মাকিন রসায়নবিদ বেনজামিন টিলগম্যান সালফিউরাস এসিডের মাধ্যমে কাঠের আঁশ পৃথক করার পদ্ধতি আবিস্কার করেন। ১৮৮২ সালে কাঠের মন্ড তৈরিতে  ব্যাপকভাবে এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হতে থাকে। ১৮৮৩ সালে র্জামান বিজ্ঞানী কার্লডাল আবিস্কার করেন যে, মন্ড তৈরিকালে সোডিয়াম সালফেট যুক্ত করা হলে আঁশগুলোর রাসায়নিক বন্ধন খুবই দৃঢ় হয়। এই আবিস্কারের নাম দেওয়া হয় ‘ক্রাফট প্রক্রিয়া’। র্জামান ভাষায় ক্রাফট মানে শক্তিশালী। ১৯০০ সালের শুরু থেকেই ক্রাফট পক্রিয়া সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রণালী হিসেবে আবির্ভূত হয়। ‘ফোরড্রাইনার’ এই যন্ত্রটি কাগজ প্রস্তুতের প্রাথমিক হাতিয়ারে পরিণত হয়। বর্তমান যুগে কাগজ প্রস্তুত প্রণালীতে অভাবনীয় উন্নতি ঘটেছে। থার্মো মেকানিকাল পাল্পিং, সিনথেটিক ওয়ারস এন্ড ফেল্টস, টুইন-ওয়ার মেশিন ইত্যাদি অত্যাধুনিক পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে কাগজ তৈরির কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে কম্পিউটার। কম্পিউটারের মাধ্যমে কাগজের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।



পূর্ববর্তী পোস্ট পরবর্তী পোস্ট

Contact Form